সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদ

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক ২০২৪) - বিজ্ঞান (অনুসন্ধানী পাঠ) - Science (Investigative Study) - NCTB BOOK

আমরা আগের শ্রেণিতে সূর্য এবং চন্দ্রগ্রহণ সম্বন্ধে বেশ কিছু ধারণা পেয়েছি, এই অধ্যায়ে আমরা সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণ সম্পর্কে আরও একটু বিস্তৃত ভাবে আলোচনা করব। গ্রহণের সময় সূর্য অথবা চন্দ্র সাময়িকভাবে আকাশে ঢাকা পড়ে যায়। পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে যে কক্ষপথে ঘোরে তা ঠিক সুষম বৃত্তাকার নয়, বরং সামান্য চ্যাপ্টা বা উপবৃত্তাকার। ফলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব সবসময় একইরকম থাকে না। সূর্যের চারপাশে একটি পূর্ণ প্রদক্ষিণ সম্পন্ন করতে পৃথিবীর সময় লাগে 365 দিন 5 ঘণ্টা 48 মিনিট 47 সেকেন্ড। এই সময়কে পৃথিবীর হিসেবে আমরা এক বছর বলি। পৃথিবী যেভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ঠিক তেমনি পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদও পৃথিবীকে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। তবে চাঁদের কক্ষপথ পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে প্রায় 5° হেলানো অবস্থায় থাকে। চাঁদের ক্ষেত্রে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করতে 27 দিনের কিছু বেশি (27.3 দিন) সময় লাগে। কিন্তু চান্দ্রমাস পূর্ণ হতে আরও দুইদিন বেশি প্রয়োজন হয়, কারণ 27.3 দিনে পৃথিবীটা সূর্যকে ঘিরে আরও খানিকটা দূরত্ব অতিক্রম করে। এই দূরত্ব অতিক্রম করে পৃথিবীকে তার নতুন অবস্থানে যাওয়ার জন্য চান্দ্রমাস শুরুর নতুন চাঁদ দেখার জন্য আরও বাড়তি দুইদিন অপেক্ষা করতে হয়। সূর্যের চারপাশে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ এবং পৃথিবীর চারপাশে চাঁদের প্রদক্ষিণ করার ফলে কিছু প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে যার কয়েকটি নিচে আলোচনা করা হলো।

7.1 চাঁদের উৎপত্তি

চাঁদের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ থাকলেও বর্তমানে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মতবাদটি হচ্ছে 'সংঘর্ষ' মতবাদ। চন্দ্রাভিযানের পর চাঁদ থেকে নিয়ে আসা চাঁদের মাটি বিশ্লেষণ করে তার সাথে পৃথিবীর মাটির বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া গেছে। সেজন্য অনুমান করা হয় সৌরজগৎ সৃষ্টির প্রথমিক সময়টিতে 'থিয়া' নামের প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান একটি গ্রহের সাথে পৃথিবীর একটি ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষে পৃথিবীর একটি অংশ উৎক্ষিপ্ত হয়ে পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে শুরু করে, যেটাকে আমরা এখন চাঁদ বলি। তোমরা যারা চাঁদের দিকে তাকিয়ে সেটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছ তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ, চাঁদ সব সময় তার একটি পৃষ্ঠ পৃথিবীর দিকে মুখ করে প্রদক্ষিণ করে, সেজন্য আমরা সব সময় চাঁদের একটি পৃষ্ঠই দেখতে পাই, অন্য পৃষ্ঠটি কখনো দেখতে পাই না। 

7.2 সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদের অবস্থান

পৃথিবীর তুলনায় সূর্যের ব্যাস প্রায় 109 গুণ বেশি। আবার চাঁদের ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের মাত্র 27% 1 অর্থাৎ চাঁদের তুলনায় সূর্যের ব্যাস প্রায় 400 গুণ বেশি। অপরদিকে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে যে গড় দূরত্ব (1,500 লক্ষ কিলোমিটার) সেটি পৃথিবী ও চাঁদের মাঝে গড় দূরত্ব (3.84 লক্ষ কিলোমিটার) থেকে 400 গুণ বেশি। সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের সময় সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ একই সরলরেখায় অবস্থান করে। ফলে কখনো পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়ে যেটি হচ্ছে চন্দ্রগ্রহণ আবার কখনো চাঁদের ছায়া পৃথিবীর উপর পড়ে যেটি হচ্ছে সূর্যগ্রহণ। সূর্যের আলো পৃথিবী কিংবা চাঁদে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে এই ছায়া সৃষ্টি করে। আলোর উৎস যদি একটি বিন্দু হয় তাহলে সেটি সুস্পষ্ট (sharp) ছায়া সৃষ্টি করে, কিন্তু সূর্যের আকার অতিকায় তাই তোমরা দেখেছ সূর্যের আলোতে সৃষ্ট ছায়া কিনারায় একটুখানি অস্পষ্ট। তার কারণ সূর্য দুই ধরনের ছায়া তৈরি করে, উপছায়া এবং প্রচ্ছায়া।

উপছায়া (Penumbra)

যখন একটি বস্তু আলোর উৎসের একটি অংশকে বাধাপ্রাপ্ত করে ছায়া তৈরি করে কিন্তু আলোর উৎসের অন্য অংশ এই ছায়াতে পতিত হয়ে আংশিক ভাবে আলোকিত করে তখন তাকে উপছায়া বলে। সে কারণে এই ছায়া আংশিক অন্ধকার হয়। স্বাভাবিকভাবেই উপছায়া অনেক বড়ো অংশ জুড়ে অবস্থান করে। 

সূর্যগ্রহণের সময়ে সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবী একই সরলরেখায় থাকে। ফলে চাঁদের উপছায়া ও প্রচ্ছায়া পৃথিবী পৃষ্ঠে পড়ে। এখানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখানো হয়েছে।

প্রচ্ছায়া (Umbra)

যখন কোনো বস্তুর অবস্থানের কারণে উৎস থেকে আলোটি সম্পূর্ণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ছায়া তৈরি করে তখন তাকে প্রচ্ছায়া বলে। এই ছায়া গাঢ় ধরনের হয় এবং গ্রহণের সময় প্রচ্ছায়া অঞ্চল কিছু সময়ের জন্য গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায়। প্রচ্ছায়া, উপছায়ার তুলনায় অনেক কম এলাকা জুড়ে অবস্থান করে।

7.3 সূর্যগ্রহণ

যখন চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময়ে ঠিক সূর্য ও পৃথিবীর মাঝামাঝি এসে পড়ে তখন সেটি সূর্যের আলোকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়-অর্থাৎ চাঁদের ছায়া পৃথিবীর কিছু অংশের উপরে পড়ে। এ ঘটনাকে সূর্যগ্রহণ বলে।

এ সময় সূর্য, চাঁদ ও পৃথিবী একই সরলরেখায় অবস্থান করে। সূর্যগ্রহণ বিভিন্ন রকম হতে পারে; যেমন-আংশিক, পূর্ণগ্রাস, বলয় এবং হাইব্রিড সূর্যগ্রহণ। তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, সূর্যের ব্যাস চাঁদের ব্যাস থেকে 400 গুণ বড়ো, তারপরেও চাঁদ কীভাবে সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলতে পারে? কারণটি সহজ, চাঁদ সূর্যের তুলনায় ছোট হলেও এটি পৃথিবীর 400 গুণ কাছে অবস্থান করে সেজন্য পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে চাঁদ ও সূর্যকে প্রায় একই আকারে দেখা যায়। চাঁদের কক্ষপথ খানিকটা উপবৃত্তাকার, এটি যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসে তখন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হয় 3.63 লক্ষ কিমি, যখন পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে তখন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব হয় 4.05 লক্ষ কিমি। চাঁদ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী দূরত্ব সবচাইতে বেশি হলে তাকে বলে অপভূ (apogee) এবং চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব সবচাইতে কম হলে তাকে বলে অনুভূ (perigee)

7.3.1 আংশিক সূর্যগ্রহণ (Partial solar eclipse)

বিভিন্ন প্রকার সূর্যগ্রহণের সময় পৃথিবী থেকে সূর্যকে বিভিন্ন রকম দেখায়। (ক) আংশিক সূর্যগ্রহণ (খ) পূর্ণ সূর্যগ্রহণ (গ) বলয় সূর্যগ্রহণ (ঘ) হাইব্রিড সূর্যগ্রষণ: যেখানে পৃথিবীর কোথাও পূর্ণ সূর্যগ্রহণ এবং কোথাও বলয় সূর্যগ্রহণ।

7.3.2 পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ (Total solar eclipse)

গ্রহণের সময় সূর্য যদি চাঁদের দ্বারা সম্পূর্ণ ঢেকে যায় তবে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ সংঘটিত হয়। আমরা জানি, চাঁদ পৃথিবীকে উপবৃত্তাকার পথে পরিভ্রমণ করে। ফলে কখনো কখনো চাঁদ পৃথিবীর কাছাকাছি অবস্থান করে (অনুভূ) তখন চাঁদকে তুলনামূলকভাবে বড়ো দেখা যায়। চাঁদ অনুভূ অবস্থানে থাকার সময় যদি সূর্যগ্রহণ হয় তবে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়ে থাকে। এরকম সময়ে যে সকল স্থানে প্রচ্ছায়া পড়ে সেই সকল স্থান থেকে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা যায়। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় সূর্যের চারপাশে তার করোনা দেখা যায়। শুধু এই সময়েই খালি চোখে সূর্যের করোনা দেখা সম্ভব হয় যেটি অন্য কখনো দেখার সৌভাগ্য হয় না।

প্রচ্ছায়া খুব সামান্য অংশ জুড়ে থাকে, আবার পৃথিবীও তার নিজ অক্ষে ঘুরতে থাকে। তার ফলে প্রচ্ছায়া একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির থাকে না, এটি পৃথিবীপৃষ্ঠে একটি রেখাপথ (একে আমরা পূর্ণগ্রাস গ্রহণরেখা বলতে পারি) বরাবর সরতে থাকে। এই রেখাপথ ভূপৃষ্ঠের যে সকল স্থানে পড়ে সে সকল স্থানে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখতে পাওয়া যায়। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের ঠিক শুরুর মুহূর্তে যখন পুরো সূর্যটা ঢেকে গিয়ে শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশ ঢেকে যাওয়া বাকী থাকে এবং শেষ হওয়ার পরের মুহূর্তে যখন পুরোটা ঢেকে যাওয়ার পর ক্ষুদ্র একটা অংশ বের হয়ে আসে তখন সেই অংশে সূর্যের তীব্র আলো দৃশ্যমান হয় এবং সেটি দেখতে অনেকটা হীরার আংটির মতো দেখা যায় বলে তাকে ডায়মন্ড রিং বলে।

7.3.3 বনয় সূর্যগ্রহণ (Annular solar eclipse)

অনেক সময় উপবৃত্তাকার পথে ভ্রমণ কালে চাঁদ এমন অবস্থানে থাকে যে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সেটি সম্পূর্ণ সূর্যকে ঢেকে রাখতে পারে না। তখন চাঁদের চারপাশে সূর্যকে আংটির মতো দেখা যায়। এই ধরনের বলয় আকৃতির সূর্যগ্রহণকে বলয় সূর্যগ্রহণ বলে।

7.3.5 সূর্যগ্রহণের প্রভাব ও গুরুত্ব

সূর্যগ্রহণের সময় পরিবেশের উপর সাময়িক প্রভাব পড়ে। আংশিক গ্রহণ অনেকটা সময় জুড়ে চলতে পারে কিন্তু পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ এর সময় সূর্য মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য সম্পূর্ণ ঢেকে যেতে পারে। পূর্ণগ্রাস গ্রহণকালীন সময়ে হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় পশুপাখিরা হতচকিত হয়ে যায়। অসময়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় অনেক পাখি ভয় পেয়ে ডাকাডাকি বন্ধ করে দেয়, ঝিঁঝিঁ পোকা শব্দ করা শুরু করতে পারে, উদ্ভিদে ফুল বুজে যাওয়া শুরু হতে পারে। কিছু কিছু স্থানে বায়ুর তাপমাত্রাও সামান্য কমে যেতে পারে।

তবে সূর্যগ্রহণ সূর্য সংক্রান্ত গবেষণার কিছু দুর্লভ সুযোগ সৃষ্টি করে। যেমন সূর্যের করোনা নিয়ে তথ্য সংগ্রহের সবচেয়ে ভালো সুযোগ সূর্যগ্রহণের সময় আসে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অবস্থিত হওয়ায় এবং চাঁদ দ্বারা সূর্য ঢেকে যাওয়ার ফলে তখন সূর্যের করোনা পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকেই পর্যবেক্ষণ করা যায়। গ্রহণের সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিশেষ করে বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশে কী ধরনের পরিবর্তন হয় তা পর্যবেক্ষণ করা যায়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরের অংশে সূর্যের তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে বিভিন্ন ধরনের চার্জযুক্ত কণা তৈরি হয়। এই অংশে পৃথিবীর অনেক কৃত্রিম উপগ্রহ অবস্থান করায় তা পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

7.3.6 সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতা

একটি বিষয় সবসময় মনে রাখতে হবে যে সূর্য থেকে অনেক ক্ষতিকর রশ্মি পৃথিবীতে আসে, যার একটি হচ্ছে অতিবেগুনি রশ্মি। আমরা যেহেতু অতিবেগুনি রশ্মি দেখতে পাই না, তাই না জেনে তার দিকে তাকিয়ে চোখের ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারি। সরাসরি সূর্যের দিকে তাকালে মাত্র কয়েক সেকেন্ডে চোখের স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে। সূর্যগ্রহণের সময় সরাসরি সূর্যের দিকে না তাকিয়ে, কোথাও সূর্যের প্রতিচ্ছবি ফেলে সেটা দেখা সবচেয়ে নিরাপদ পদ্ধতি। পিনহোল ব্যবহার করে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করা সহজ, একটি শক্ত কাগজে ছোট একটি ছিদ্র করে তার মধ্যে গ্রহণের সময় সূর্যের আলো অপর একটি পর্দায় ফেললে সেখানে সূর্যগ্রহণ দেখা যায়।

7.4.4 চন্দ্রগ্রহণ

চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করার সময় অনেক ক্ষেত্রে এমন অবস্থানে চলে আসে যে চাঁদ এবং সূর্যের মাঝামাঝি পৃথিবী অবস্থান করে। এক্ষেত্রে সূর্য পৃথিবী এবং চাঁদ এক সরলরেখায় থাকে, ফলে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপরে পড়ে এবং চন্দ্রগ্রহণ হয়। চন্দ্রগ্রহণের সময় কখনো পৃথিবীর উপছায়া কখনো প্রচ্ছায়া কিংবা কখনো দুটিই চাঁদের উপর পড়ে।

চন্দ্রগ্রহণ তিন রকম হতে পারে: পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ, আংশিক চন্দ্রগ্রহণ এবং উপছায়া চন্দ্রগ্রহণ।

7.4.1 পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ (Total lunar eclipse)

পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদ পৃথিবীর প্রচ্ছায়ার মাঝে অবস্থান করে। এ সময় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দ্বারা সূর্যের আলোর অপেক্ষাকৃত ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের রশ্মি (যেমন: বেগুনি, নীল ইত্যাদি রঙের আলো) বাইরের দিকে বিচ্ছুরিত হয়। অপরদিকে অপেক্ষাকৃত লম্বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের লাল আলো ভিতরের দিকে প্রতিসরিত হয়ে চাঁদের উপরে পড়ে, ফলে চাঁদকে তার স্বাভাবিক সাদাটে ধূসর বর্ণের পরিবর্তে লাল বর্ণের দেখা যায়। শুধু পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণ হয়ে থাকে তবে চাঁদের কক্ষপথ প্রায় 5° বাঁকানো থাকায় প্রতি পূর্ণিমায় চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায় না। সূর্যগ্রহণের তুলনায় চন্দ্রগ্রহণ দীর্ঘ সময়ব্যাপী হয়ে থাকে।

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দ্বারা সূর্যের আলোর নীল অংশ বাইরের দিকে বিচ্ছুরিত হয় বলে ভিতরের দিকের আলো লালাভ হয়। পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের সময় সেই আলোতে চাঁদকে লালচে দেখায়।

7.4.2 আংশিক চন্দ্রগ্রহণ (Partial lunar eclipse)

আংশিক চন্দ্রগ্রহণের সময় সূর্য, পৃথিবী এবং চাঁদ এমনভাবে অবস্থান করে যে চাঁদের কিছু অংশ পৃথিবীর প্রচ্ছায়া এবং বাকি অংশ উপছায়া দ্বারা আবৃত হয়। এক্ষেত্রে চাঁদের কিছু অংশ গাঢ় ছায়ায় আবৃত দেখা যায়।

7.4.3 উপছায়া চন্দ্রগ্রহণ (Penumbral lunar eclipse)

চাঁদ পৃথিবীর উপছায়ার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করার সময় উপছায়া চন্দ্রগ্রহণ পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেহেতু উপছায়া প্রচ্ছায়ার তুলনায় হালকা তাই এই ধরনের চন্দ্রগ্রহণ খুব ভালো করে না দেখলে বোঝা যায় না। এ সময় চাঁদকে তার স্বাভাবিক বর্ণের তুলনায় হালকা গাঢ় বর্ণের দেখা যায়।

7.5 অ্যানালেমা (Analemma)

তোমরা যদি কোনো বিল্ডিং, দেওয়াল, জানালা কিংবা অন্য কোনো স্থাপনার ছায়া একই জায়গায় একই সময় নিয়মিতভাবে দেখে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ যে, সেটি বছরের সব সময় একই রকমভাবে এক জায়গায় দেখা যায় না। বছরের বিভিন্ন সময়ে সেটি ধীরে ধীরে স্থান পরিবর্তন করে। তার কারণ সূর্য প্রতিদিন একই সময়ে আকাশের একই স্থানে অবস্থান করে না। জুন মাসের 21 তারিখ সূর্য ঠিক কর্কটক্রান্তি রেখার উপর লম্বভাবে থাকে, যেহেতু কর্কটক্রান্তি রেখাটি বাংলাদেশের উপর দিয়ে গিয়েছে তাই ঐ সময়ে আমরা সূর্যকে ঠিক মাথার উপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে দেখি। যতই দিন যেতে থাকে সূর্যটি ততই দক্ষিণ দিকে হেলে যেতে থাকে। ছয় মাস পর ডিসেম্বরের 22 তারিখ সূর্য ঠিক মকরক্রান্তি রেখার উপর লম্বভাবে থাকে তাই আমাদের দেশ থেকে আমরা সূর্যকে সবচেয়ে বেশি হেলানো অবস্থায় পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে যেতে দেখি। তারপর সূর্য আবার উত্তর দিকে ফিরে আসতে থাকে এবং ছয় মাস পর আবার ঠিক আমাদের মাথার উপর দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায়।

তুমি যদি প্রতিদিন একই সময়ে আকাশের একই দিকে সুনির্দিষ্টভাবে ক্যামেরা বসিয়ে সূর্যের ছবি তোল এবং বছর শেষে সবকটি ছবি একত্র করে একটি ছবি তৈরি কর তাহলে তুমি সূর্যের অবস্থানের পরিবর্তনটি দেখবে, পাশের ছবিতে সেটি দেখানো হয়েছে। বছরের ভিন্ন সময়ে আকাশে এই পর্যায়ক্রমিক সূর্যের অবস্থানকে অ্যানালেমা বলে। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর উপবৃত্তাকার কক্ষপথ এবং তার অক্ষের কাত হওয়ার কারণে অ্যানালেমা বা সূর্যের অবস্থানের পরিবর্তনটি দেখায়। অ্যানালেমার আকৃতি বাংলা চার (4) কিংবা ইংরেজি আটের মতো।

তোমরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ অ্যানালেমার দুইটি লুপের মাঝে নিচেরটি বড়ো এবং উপরেরটি ছোটো। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর কক্ষপথ যদি উপবৃত্তাকার না হয়ে বৃত্তাকার হতো তাহলে দুটি লুপের আকার সমান হতো। আবার কক্ষপথ উপবৃত্তাকার হলেও পৃথিবীর অক্ষ যদি 23.5 ডিগ্রিতে হেলানো না হয়ে খাড়া হতো তাহলে অ্যানালেমাটি হতো একটি সরল রেখা। যদি খাড়া অক্ষ এবং একই সাথে বৃত্তাকার কক্ষপথ হতো তাহলে আমরা অ্যানালেমার কোনো আকার পেতাম না, সারা বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে সূর্যটি স্থান পরিবর্তন না করে একই অবস্থানে থাকতো।

অ্যানালেমা একটি চমকপ্রদ বিষয় যেটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা শত শত বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন। এটি একটি নির্দিষ্ট অবস্থানের অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশ, তারিখ এবং সময় নির্ধারণ করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর কক্ষপথ এবং অক্ষীয় হেলানোর (Tilt) পরিবর্তনগুলোও শনাক্ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

7.6 পৃথিবীর কক্ষপথ ও অক্ষের পরিবর্তন

আমরা পৃথিবীর নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনকে আহ্নিক গতি এবং সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণনকে বার্ষিক গতি বলি। পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বরাবর কাল্পনিক রেখাটি হচ্ছে পৃথিবীর অক্ষ। এই অক্ষটি পৃথিবীর কক্ষপথের সমতলের সাপেক্ষে 23.5° কোণে হেলে থাকে। এই হেলানো অক্ষ নিয়ে পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ভ্রমণ করে। যদিও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা এই কক্ষপথ কিংবা হেলানো কক্ষপথের কোনো পরিবর্তন দেখি না, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই উপবৃত্তাকার কক্ষপথ এবং হেলানো অক্ষ খুবই ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। যেহেতু পৃথিবীর কক্ষপথ এবং হেলানো অক্ষ ঋতু পরিবর্তন এবং দিনের আলোর সময়ের দৈর্ঘ্যের জন্য দায়ী, তাই কক্ষপথ ও অক্ষের সূক্ষ্ম পরিবর্তন এই গ্রহের দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু এবং ভূপৃষ্ঠের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে।

7.6.1 কক্ষপথের পরিবর্তন

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ভ্রমণ করে, যার অর্থ সূর্য থেকে এর দূরত্ব সবসময় এক নয়। কখনো এটি সূর্যের একটু কাছে থাকে, কখনো একটু দূরে থাকে। কক্ষপথের যে বিন্দুতে পৃথিবী সূর্যের সবচেয়ে কাছে থাকে তাকে অনুসুর (Perihelion) বলা হয়, আর যে বিন্দুতে সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে থাকে তাকে বলা হয় অপসুর (Aphelion)। অনুসুর ঘটে জানুয়ারির প্রথমদিকে, তখন সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব 14.7 কোটি কিলোমিটার এবং অপসুর ঘটে জুলাইয়ের শুরুর দিকে তখন সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব 15.2 কোটি কিলোমিটার। যখন পৃথিবী অনুসুরে থাকে, তখন এটি অপসুরের তুলনায় 3% কাছে থাকলেও প্রায় 7% বেশি সৌর বিকিরণ পায়। এটি একটি ছোট পার্থক্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এটি আসলে পৃথিবীর জলবায়ুর উপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে।

পৃথিবীর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার বলা হলেও বর্তমানে এটি আসলে প্রায় বৃত্তাকার। তবে এই কক্ষপথের আকৃতি সবসময় একইরকম থাকে না। প্রতি 90 থেকে 100 হাজার বছরে পৃথিবীর কক্ষপথ প্রায় বৃত্তাকার আকৃতি (অর্থাৎ যখন অনুসুর ও অপসুরে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের পার্থক্য সবচেয়ে কম) থেকে সর্বোচ্চ উপবৃত্তাকার আকৃতির (অর্থাৎ যখন অনুসুর ও অপসুরে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্বের পার্থক্য সবচেয়ে বেশি) মাঝে পরিবর্তিত হয়। সর্বোচ্চ উপবৃত্তাকার কক্ষপথে থাকা অবস্থায় পৃথিবীর অনুসুর ও অপসুরে সৌর বিকিরণ পাওয়ার পার্থক্য 20% থেকে 30% পর্যন্ত হতে পারে, কাজেই এই দুই অবস্থানে থাকাকালে পৃথিবীর আবহাওয়ার পার্থক্য হবে সবচেয়ে বেশি।

7.6.2 পৃথিবীর অক্ষের অগ্রগতি (Precession)

কখনো কোনো লাটিম ঘুরতে দেখলে খেয়াল করবে এটি একেবারে স্থির হয়ে ঘোরে না, এটি কিছুটা টলমল করে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর অক্ষও ঠিক সেরকম। লাটিমের মাথা টলমল করে ঘুরতে ঘুরতে তার মাথার উপরে শূন্যে একটা কাল্পনিক বৃত্ত তৈরি করে আবার সে তার আগের জায়গায় ফিরে আসে। ঠিক সেরকম পৃথিবীর অক্ষও প্রতি 26 হাজার বছরে মহাকাশীয় গোলকের গায়ে একটা বৃত্ত তৈরি করে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। পৃথিবীর উত্তর মেরু যে বিন্দু বা নক্ষত্র বরাবর থাকে সেটাকেই আমরা ধ্রুবতারা বলি। দেখা যাচ্ছে ধ্রুবতারা নামে ধ্রুব হলেও সেটা আসলে পৃথিবীর অক্ষের পরিবর্তনের কারণে সময়ের সাথে পাল্টাচ্ছে। পৃথিবীর অক্ষের এই ঘূর্ণনকে 'পৃথিবীর অক্ষের অগ্রগতি' বলা হয়।

বর্তমানে পৃথিবীর উত্তরমেরু পোলারিস নক্ষত্রকে নির্দেশ করে বলে সেটাই আমাদের ধ্রুবতারা। আজ থেকে 14 হাজার বছর পরে এটি ভেগা নক্ষত্রের দিকে নির্দেশ করবে, তখন সেটাই হবে নতুন ধ্রুবতারা।

7.6.3 পৃথিবীর অক্ষের তির্যকতা (Obliquity):

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি যে পৃথিবীর অক্ষ তার কক্ষপথের সমতলের সাপেক্ষে 23.5° হেলানো অবস্থায় আছে, কক্ষপথের সাপেক্ষে এই হেলানোর পরিমাপকে পৃথিবীর অক্ষের তির্যকতা বলা হয়। পৃথিবীর অক্ষের এই তির্যকতাও খুব ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। এই মুহূর্তে পৃথিবীর তির্যকতা 23.5° কিন্তু এটি খুব ধীরে ধীরে কমছে। প্রায় 41,000 বছরের একটি চক্রে পৃথিবীর তির্যকতা 22.1° থেকে 24.5°-এর মাঝে পরিবর্তিত হয়। এই তির্যকতা যত বেশি হয় ঋতুগুলোর মাঝে আবহাওয়ার পার্থক্য তত বেশি হয়, অর্থাৎ তখন গ্রীষ্মকাল বেশি গরম এবং শীতকালে বেশি শীত হয়ে থাকে।

প্রশ্ন: পৃথিবীর কক্ষপথ সবচেয়ে বেশি উপবৃত্তাকার হওয়া, পৃথিবীর অক্ষের অগ্রগতি এবং পৃথিবীর অক্ষের তির্যকতার হ্রাস-বৃদ্ধি, এই তিনটি পরিবর্তনের মাঝে কোনটি জলবায়ুকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে এবং কেন?

Content added By
Promotion